সকলকে ঝিনাইদহ ইনফো সাইটে স্বাগতম জানাচ্ছি। এই সাইটে আমরা ঝিনাইদহের ইতিহাস,ঐতিহ্য আপলোড করবো। ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস,ঐতিহ্য,ভ্রমন কাহিনী আপনিও দিতে পারেন। আমরা আপনার নামসহ এই সাইটে প্রকাশ করবো। আপনার লেখা আমরা প্রত্যাশা করছি। ইমেইল করুন: jhenaidahinfo@gmail.com

Tuesday, August 14, 2018

ঝিনাইদহে ঢোল সমুদ্র দীঘি

ঝিনাইদহে ঢোল সমুদ্র দীঘি
Dhol Shumuddro Lake


ঢোল সমুদ্র দীঘি খননের পেছনে জনশ্রুতি আছে যে, রাজা মুকুট রায়ের রাজত্বকালে একবার জলকষ্ট দেখা দেয়। বিল, বাওড়, নদী দীঘি- কোথাও জল ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে রাজা দীঘি খননের সিদ্ধান্ত নেন। অগণিত লোকের দিন রাত পরিশ্রমে দীঘি গভীর হতে গভীরতর এবং চতুর্দিকে প্রশস্ত হতে লাগল। কিস্তু পুকুরে জল উঠল না। হতাশ রাজা একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে, রাণী যদি পুকুরে নেমে পূজা দেন, তবে পুকুরে জল উঠবে। এ কথা জেনে প্রজাহিতৈষী রাণী পূজার নৈবেদ্য নিয়ে পুকুরে নামলেন। রাণী পুকুরের তলদেশে উপস্থিত হয়ে ইষ্টদেবতাকে নিবেদন করলেন পূজার অর্ঘ্য। জল ওঠা শুরু হলো। প্রার্থনা পূর্ণ হওয়ায় রাণী উপরে উঠতে শুরু করলেন। সহসা প্রবলবেগে জলরাশি উথ্তি হল। জল দেখে উদ্বেলিত পাড়ের সহস্র প্রজার উৎসব-আনন্দ আর বাদ্য-বাজনার মধ্যে অলক্ষ্যে রাণী অথৈ জলরাশির গভীরে তলিয়ে গেলেন। গভীর শোকে শোকাভিভূত প্রজাগণ রাজাকে রাজপুরীতে যেয়ে এই দুঃসংবাদ জানালেন। সেই স্মৃতি স্মরণে আজও লোকজন এ দীঘিকে ঢোল সমুদ্র দীঘি বলে জানে। ঝিনাইদহ শহরের নিকটবর্তী ঐতিহ্যবাহী পাগলা কানাই ইউনিয়নের বাড়িবাথান গ্রামে প্রায় ৫২ বিঘা জমির উপর এই ঢোল সমুদ্র দীঘি অবস্থিত। এটি ঝিনাইদহের সর্ববৃহৎ দীঘি। ঢোল সমুদ্র দীঘিটি ঝিনাইদহের একটি আকর্ষণীয় বিনোদন স্থান।

অবস্থান: ঝিনাইদহ > পাগলাকানাই > বাড়িবাথান

দুরত্ব: ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্ত্বর থেকে ৪ কি.মি

যাতায়াতের মাধ্যম: পায়রা চত্ত্বর থেকে / পাগলা কানাই মোড় থেকে ইজিবাইক / ভ্যান / রিক্সা চড়ে যাওয়া যায়। যাতায়াত খরচ ৩০/৪০ টাকা।

ইতিহাস থেকে আরো জানা যায,  
বেশ ক’জন রাজা মুকুটরায় ছিলেন বলে শোনা যায়। এদের একজন ঝিনাইদহ সদরের বলে জনশ্রুতি আছে। জনশ্রুতি বললে অন্যায় হবে, ঐ নামের প্রভাবশালী কেউ ছিলেন এখানে তাতে সন্দেহ নেই। জেলা সংলগ্ন বেড়বাড়ী গ্রাম মাত্র ২/৩ মাইলের ব্যবধান। ঝিনাইদহ চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড যেতে বাঁদিকে আরো আসতে ডান দিকে পাগলা-কানাই সড়ক ধরে এগোলে চোখে পড়বে এক দীঘি। আসলে রাজা এটা কেটেছিলেন পুকুর বলে। আকারে বড় বলে লোকে একে দীঘি বলে। নাম ঢোল সমুদ্র। এ সমুদ্র খননের পিছনে একটা লোকশ্রুতি আছে।  শোনা যায় রাজা মুকুট রায়ের আমলে একবার ভীষণ জলকষ্ট দেখা দেয়। উৎকন্ঠা আর উদ্বেগ প্রজা মহলের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জলের অভাবে প্রজারা প্রাণ দিতে লাগল। বিল, বাওড়, নদী, দীঘি কোথাও জল নেই। রাজা অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন। জলের জন্য পূজা দিলেন। অনেক ধর্মীয়-আচার অনুষ্ঠান করলেন। কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে রাজা স্থির করলেন একটা পুকুর খননের। প্রজারা অবশ্যই জল পাবে সেখান থেকে। দেখতে দেখতে জলাশয় খনন কাজ শুরু হয়ে গেল। অগণিত লোক কোদাল চালালে রাতারাতি খননকাজ শেষ করতে। পুকুর গভীর হতে গভীরতর হলো, জলের দেখা পাওয়া গেলনা। প্রজাদের হাহাকার রাজ্যে বিপদ সংকেত ঘোষণা করল। পুকুরে জল উঠলোনা। কত জ্যোতিষী, কত দরবেশ এলো। কত উপদেশ পালিত হলো। কিছুতেই কিছু হলো না। রাজার রাত্রে ঘুম নেই। তিনি হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন। একদিন রাত্রে রাজা স্বপ্ন দেখলেন, যদি রাণী পুকুরে নেমে পূজা দেন, তবে পুকুরে জল উঠবে। রাজা অনন্যোপায় হয়ে স্বপ্নের কথা রাণীকে বললেন। রাণী প্রজাহিতৈষী প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করলেন। ধূমধাম পড়ে গেল, দিন ক্ষণ ঠিক হলো। ঢোল, সানাই, বাঁশি এলো। লোকে লোকারণ্য পুকুর পাড়। রাণী পূজার নৈবেদ্য নিয়ে পুকুরের পাড়ে আসলেন। ঢোল, সানাই, বাঁশী বেজে উঠলো। শঙ্খবাণী, উলুধ্বনি দিল মায়েরা। রাণী ধীরে ধীরে পুকুরে নামতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তলদেশে উপস্থিতি। সহসা দেখা গেল তলা থেকে জল উঠছে প্রবল বেগে। রাণী প্রজাদের মঙ্গল কামনা করে ঈশ্বরকে প্রনতি জানিয়ে পুকুর হতে উঠে আসতে লাগলেন। জল তবেগে রাণীর শরীর বেয়ে উঠতে লাগলো। ঢোল, কাশী, সানাই, বাঁশীর শব্দের এবং প্রজাদের আনন্দে পুকুরের দিকে কারো লক্ষ্য নেই। সকল আওয়াজ ছাড়িয়ে বাজনার শব্দ সব কিছুকে তলিয়ে দিচ্ছিল। রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন অনেকে। জলের স্তর ক্রমাগত বেড়ে রাণীর গলা ডুবিয়ে দিল। দেখতে মাথা; এমনকি চুল পর্যন্ত। কারো খেয়াল নেই। এক সময় দেখা গেলো রাণীকে আর দেখা যাচ্ছে না। প্রজাদের উল্লাস থেমে গেলো। দুঃসংবাদ রাজপুরে পৌঁছালো। রাজা এলেন। আর্তনাদ করে রাণী রাণী বলে চীৎকার দিতে শুরু করলেন। প্রজারা মলিন মুখে রাজার পানে চেয়ে রইলেন। শেষ পর্যন্ত রাণীর খোঁজ হলো। লোকে পুকুরটিকে ঢোল সমুদ্র বলে।

বিজয়পুর গ্রামে রাজার রাজধানী ছিল। বাড়ীবাথানে গোশালা, বেড়বাড়ীতে উদ্যান, কোড়াপাড়ার কোড়াদার সৈন্যের আবাসস্থল ছিল। রাজা মুকুট রায়ের সেনাপতি ছিলেন শৈলকুপার রঘুপতি ঘোষ রায়। একবার বঙ্গেশ্বর তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে সৈন্য প্রেরণ করেন। নবাব সৈন্য রাজা মুকুট রায়ের নিকট পরাজিত হয়। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আহলাদে আত্মহারা হয়ে নিজের একজন সৈন্যকে কালী মন্দিরে বলির আদেশ দেন। এ ঘটনার পর পাঠান সৈন্যরা তার পক্ষ ত্যাগ করে নবাবের পক্ষে যোগ দেয় এবং বাড়ীবাথানের যুদ্ধে রাজাকে পরাজিত করে। পরবর্তীকালে নবাব সৈন্যরা রাজা মুকুট রায়কে বন্দী করে রাজধানীতে নিয়ে যায়। রাজার বিরোচিত পরিচয় জেনে নবাব তাঁকে মুক্তি দেন। এদিকে পরিবারের সদস্যগণ রাজার অনিবার্য পরিণতিতে বিভ্রান্ত হয়ে সবাই আত্মহত্যা করেন। কন্যার আত্মহত্যা স্থলকে কন্যাদহ, দুই রাণীর আত্মহত্যা স্থলকে দুই-সতীনে, রাজ জ্যোতিষীর আত্মহত্যা স্থলকে দৈবজ্ঞদহ নামগুলি আজো জনপদের অনেকের কাছে পরিচিত।

শুরুতে তিনি ছিলেন জমিদার। ভাগ্যগুণে রাজা উপাধি পান। ঝিনাইদহ অঞ্চলে তার অনেক কীর্তি আছে। রাজার ভাইয়ের নাম গন্ধ রায়। গৌড় বাংলার সুলতান তাকে খা উপাধিতে ভূষিত করেন। রাজা মুকুট রায়ের অনেক সৈন্য-সামন্ত ছিল। ১ হল্কা হাতি বহ, ২০ হল্কা ঘোড়া বহর এবং ২২০০ কোড়াদার সৈন্য ছাড়া তিনি বাইরে যেতেন না। বংগীয় স্বাধীন যুগে জনপদের বিভিন্ন স্থানে আরো অনেক জমিদার বা রাজা থাকা অস্বাভাবিক নয়। স্বীকর করতেই হবে অধিকাংশই বার-ভূঁইয়াদের বংশধর।



তথ্য সূত্র:
যশোর গেজেটিয়ার

No comments:

Post a Comment